
রাজনীতিতে পা বাড়ানোর শুরুতেই যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে উজ্জ্বল ঊষার আলোকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করেছেন, খালেদা জিয়া তাঁদের মধ্যে অদ্বিতীয়। তিনি সময়ের আবর্তনে বিশ্ব রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মুখ। মিছিলের পুরোভাগে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক উন্নত শির, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং আপসহীন নেত্রী। অন্যায়, অনিয়ম, অবিচারের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি স্বৈরাচার ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক।
বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আপসহীন বেগম খালেদা জিয়াজনগণ তাঁকে বিপুল ভোটের মাধ্যমে পাঁচবার অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে (১৯৯১-২০০৮) বিজয়ী করেন। চারবার তিনি পাঁচটি করে আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হন এবং একবার তিনটি আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশের সেরা রেকর্ড নয়, বিশ্বের কাছেও অনন্য রেকর্ড।
দীর্ঘ ৯ বছরের রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এরশাদের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার সংগ্রাম ছিল ইস্পাতদৃঢ় ও আপসহীন। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন হলো—মা, মাটি, মানুষ, এ দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি এবং সর্বোপরি দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। রাজনৈতিক আদর্শ হলো—শহীদ জিয়ার সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম, শিষ্টাচার, শালীনতা এবং জনকল্যাণমূলক রাজনীতি।
বেগম জিয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০১১ সালের ২৪ মে তাঁকে ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ হিসেবে উপাধি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি স্টেট সিনেট।
আর একবার যে সিদ্ধান্ত নিতেন, সেই সিদ্ধান্ত থেকে কখনো পিছু হটতেন না। যার প্রমাণ ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের শাসনামল ও ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার আমলে তাঁর বিরুদ্ধে গৃহীত মিথ্যা মামলা, জেল ও নির্যাতন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এবং দেশের যেকোনো রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে সাধারণ মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনিও সব সময় জনগণের পাশেই ছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। যেগুলো এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ। এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনায় ৬০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করেন, যাতে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের গুরুত্বসহকারে অবস্থান দেওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় সংগ্রাম ও রাষ্ট্র গঠনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন।
বেগম খালেদা জিয়া সরকারের আমলে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। শুধু তৈরি পোশাক শিল্প খাতেই প্রথম পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯ শতাংশ। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাক শিল্প খাতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানিবণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন, যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাঁকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনিই প্রথম রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মায়ানমার সরকার নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২৯ নম্বরে স্থান করে নেন তিনি। বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে এক রূপান্তরমূলক নেতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নারীর সামাজিক অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করেন এবং শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়নে ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়ন করেন। তাঁর সময়ে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন, মেয়েদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশোনা, শিক্ষা উপবৃত্তি ও Food for Education কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে দেশে নারী শিক্ষা অভূতপূর্ব অগ্রগতি লাভ করে; ফলে ১৯৯১-১৯৯৬ সালে স্কুলে ছেলে-মেয়ের অনুপাত ৫৫:৪৫ থেকে ৫২:৪৮-এ উঠে আসে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করেন। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নে তিনি ১৯৯৫ সালে বেগম রোকেয়া পদক প্রবর্তন, নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে কঠোর আইন, মাতৃস্বাস্থ্য প্রকল্প, সংসদে সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি এবং ২০০১ সালে Asian University for Women প্রতিষ্ঠাসহ অসংখ্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তাঁর এই নেতৃত্বগুণ ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৪ সালে Forbes তাঁকে বিশ্বের ১৪তম ক্ষমতাধর নারী নেত্রী হিসেবে স্থান দেয়।
১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। এই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তিনি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। খালেদা জিয়া এই সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া, তাঁর পরিবার ও দল বিএনপির ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে। এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়াকে জোর করে বিদেশ পাঠাতে ব্যর্থ হলে ছোট ছেলে কোকোকে ২৪ ঘণ্টা অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয় এবং বেগম খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।’ এরপর কার্যত তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। তাঁর দুই ছেলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যু, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ও বড় ছেলের নির্বাসন সহ্য করেও মহাজোট সরকারের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির সাজানো মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার সময় তিনি শেষবারের মতো হেঁটে চলাফেরা করেছিলেন। ২০২০ সালের মার্চে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বন্দিজীবনে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হন তিনি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিকবার মৃত্যুর গুজবও ছড়ায়।
করোনার শুরুতে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও ছিলেন কার্যত গৃহবন্দি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্ত হন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা এক অদম্য নেত্রী, গণমানুষের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল ও প্রত্যাশার আলোকবর্তিকা বেগম খালেদা জিয়া গতকাল মঙ্গলবার সকালে পরলোকগমন করেছেন। দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে অন্যায়-অনিয়মের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মানুষের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবেন বেগম খালেদা জিয়া।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, কালের কণ্ঠ



