কে? কোথায়? কখন? কিভাবে শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর বলে আখ্যায়িত করেছিল তার সঠিক তথ্য অজানা। তবে কারিগর শব্দটিকে যদি একক হিসাবে ধরি তাহলে দেখা যাবে সেটি খুব একটা সম্মান জনক পেশার বা শ্রেণীর লোককে বোঝায় না। তথাপিও কারিগর শব্দটি শিক্ষকের ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে শিক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যক দক্ষতা সম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষের আবয়ব আমাদের মানষ পটে চিত্রিত হয় যার উন্নত ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, নীতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দর্শণ সমাজের সর্বস্তরে অনুসরণ যোগ্য। কারিগর যেমন তার হাতিয়ার দ্বারা কোন কিছু তৈরি করতে সক্ষম তেমনি শিক্ষকের হাতিয়ার হল তার দর্শণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, প্রস্তুত, কৌশল ও দক্ষতা। সম্ভবত এমন একটি ধারণা থেকে শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
ধরা যাক শিক্ষকতা একটি পেশা কেননা এই পেশা আমাকে স্বক্রীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ কাজ করে আমি আনন্দ পাই ও গর্ববোধ করি। আমার কর্ম ক্ষেত্রে মানসিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত চাহিদা নিবৃত্তির জন্য অর্থও যোগান দেয়। একই সাথে জৈবিক ও মানসিক চাহিদা মেটায় বলে শিক্ষকতা আমার বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের উপর আমি যখন গুরুত্ব দিয়ে থাকি তা হল মূল্যবোধ।
বিশ্বাস মানব মনের একটি বিমূর্ত ধারণা। জন্মলগ্ন থেকে কোন মানুষ যা দেখে, শোনে, বোঝে যা থেকে তার ধারণা জন্ম নেয় তা থেকেই তার আদর্শ গড়ে ওঠে। আদর্শ তাকে বিশ্বাস গড়ে তুলতে অনুপ্রানিত করে। মানুষ যখন কোন কিছুতে আস্থা রাখতে শেখে সেখান থেকে তার বিশ্বাসের জন্ম দেয়। যখন তার কোন ধারণা, আদর্শ বা কৌশলের উপর বিশ্বাস জন্ম নেয় এবং ঐ সব নিয়ম নীতি বা কর্ম প্রেরনার উৎসকে ব্যক্তির বিশ্বাস হিসাবে গন্য করি। বিশ্বাস থেকে ব্যক্তির নৈতিকতা সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তি জীবনে কর্মে বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে উৎসাহী হয়। বিশ্বাসের উৎপত্তি হয় ব্যক্তির মানসিক সংগঠন থেকে। তাই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর কল্যান মূখী ও সৃজনশীল শিখনের জন্য শিক্ষন পরিচালনায় উদ্ভুদ্ধ হন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তার চিন্তা চেতনায় কাজে কর্মে সর্বত্র শিক্ষার্থীর ইতিবাচক শিখন সংক্রান্ত যাবতীয় বিশ্বাস প্রয়োগ করতে থাকেন। বিশ্বাসের সাথে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা, নীতিবোধ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহ্য গত ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত। একজন শিক্ষকের বিশ্বাস তার পেশাগত কাজে তাকে অনুপ্রেরণা যোগায়। এ কারনে ইতিবাচক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য কারন এ বিশ্বাসই তার পেশাগত জীবনের পাথেয়।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে মুল্যবোধের কাঠামো। যেমন একজন ব্যক্তি মানবিকতায় বিশ্বাসী হওয়ায় সে প্রানীজগতের উপর সহানুভূতিশীল হয় অর্থাৎ বিশ্বাস তাকে মানবিক আচারণ করতে উদ্ভূদ্ধ করেছে। তাই তিনি মানবিক আচরণকে গুরুত্ব দেন। এটাই তার মূল্যবোধ। মূল্যবোধ ব্যক্তির এমন শক্তি যার গুনে সে নিজের বৈশিষ্ট্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং যা সে চায় তাই অন্যের মধ্যে বিকশিত করতে পারে। যে ব্যক্তি ইতিবাচক বা কল্যানকর গুনাবলীকে মূল্য দেন তিনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্য। কারন তার মূল্যবোধ ও দর্শণ দ্বারা তিনি শিক্ষার্থীদের প্রভাবান্বিত করতে পারেন। আধুনিক ধারনা অনুযায়ী মূল্যবোধ হলো কতগুলো জৈব মানসিক সংগঠনের এমন এক সমন্বয় যা পরিবেশের বৃহৎ অংশকে সক্রিয়তার দিক থেকে সমগুন সম্পন্ন করে তোলে এবং ব্যক্তির মধ্যে উপযুক্ত আচরণ সৃষ্টি করে।
কালের পরিক্রমায় যেমন শিক্ষণের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য, চাহিদা, পরিবর্তীত রূপ লাভ করেছে, তেমনি পরিবর্তীত হয়েছে শিখন কৌশলের। তবে গ্রীক, স্পার্টা, রোমানদের সভ্যতা বিকাশের প্রাক্কালে শিখনের উদ্দেশ্য ও ক্ষেত্র যেমন ছিল বর্তমানে তা নবায়ন হয়েছে মাত্র। তখন শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল দেশ রক্ষার জন্য উন্নত বাহিনী গঠন শিক্ষার শারীরিক, নান্দনিক ধর্মীয় বিকাশ সাধন। তখন কার যুগের দার্শনিক সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল, প্লেটোর ধারনা, মতবাদ বর্তমান কালেও ঠেলে ফেলার উপায় নেই। শুধু মাত্র পরিসর বৃদ্ধি করা ছাড়া। অর্থাৎ তাদের মতবাদের সাথে কিছুটা সংযোগ করা হয়েছে মাত্র। দেশ রক্ষার জন্য দেশকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাচীন কালেও যেমন সৈন্য বাহিনীর দরকার ছিল, তেমনি বর্তমানেও দক্ষ কর্মী বাহিনী প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন দক্ষ কারিগর।
যেহেতু উন্নত ও আদর্শ ব্যক্তি গঠন শিক্ষার লক্ষ্য। তাই একজন শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে কর্মে বিশ্বাস প্রতিফলিত করে কর্মোদ্যোমী হয়ে উঠতে হবে। নিজেকে উৎকৃষ্ট ও উত্তম মনে বিবেচনা পূর্বক কাজের ক্ষেত্র রচনা করতে হবে ও কর্ম সম্পাদন করতে হবে। এভাবে নিজের মধ্যে একজন আত্মবিশ্বাসী ও প্রত্যয়ী ব্যক্তির ঠিকানা লাভ করবে। সুশৃঙ্খল ও উন্নত বিদ্যালয় পরিবেশ সৃষ্টি করা সহজ হবে। তেমনই উন্নত ও দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ তথা জাতি গঠন সম্ভব হবে। একজন শিক্ষক শুধু বিষয় বস্তু শিক্ষনই দেন না, তিনি শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করেন। শ্রেণী পরিবেশ নিয়ন্ত্রন করেন, শিক্ষার্থীর যে কোন সমস্যায় নির্দেশনা দেন, এমনকি তার সাথে শিক্ষকের টাকা-পয়সা লেনদেনও করতে হয়। প্রতিক্ষেত্রে শিক্ষকের আচরণ শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করে। একজন শিক্ষক নিজ বৈশিষ্ট্যে যথার্থ মূল্যবোধ গড়ে তুলে সামাজের প্রত্যাশিত ও সমগুন সম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে সক্ষম তাই তিনি মানুষ গড়ার কারিগর।
– চৌধুরী নাজির আহমেদ
প্রধান শিক্ষক
ডুমারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
কালিয়া, নড়াইল।