মাইনুল ইসলাম মহিন
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্তমান সময়টাকে ‘কঠিন’ আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হলে পেছনে পড়তে হবে, পড়তে হবে খাদে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণে শুক্রবার রাজধানীতে এক আলোচনায় তিনি এসব বক্তব্যের পাশাপাশি বলেছেন, একাত্তরকে ভুলে গেলে চলবে না।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে এই আয়োজনে ফখরুল এই দিবসগুলোকে অবহেলা না করে জানার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বুঝেশুনে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে বিএনপি নেতা বলেন, “এই সময়টা সবচাইতে কঠিন সময়।আপনার একটা পদক্ষেপ যদি ভুল হয় আপনি পেছনে পড়ে যাবেন, খাদে পড়ে যাবেন। যদি সঠিক পা দিতে পারেন তাহলে আপনি সামনে এগিয়ে যাবেন “
প্রতিটি মুহূর্তে সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “আমাদেরকে ‘মেপে’ কথা বলা দরকার। আমরা এমন কোনো কথা বলব না যা আমাদের এই যে বিজয়কে নষ্ট করে দেয়, অর্জনকে বিনষ্ট করে দেয়।
আমাদের দেশের ‘ফ্যাসিস্ট’ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতে আশ্রয় নিয়ে সে দ্রুত কাজ করছে, সে লন্ডনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে একটা মিটিংও করেছে এর মধ্যে ডিজিটালি।”
আওয়ামী লীগ অনেক ‘অপপ্রচার’ ও ‘মিথ্যাচার’ করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আপনাদেরকে গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে জবাব দিতে হবে।”ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বানও জানান ফখরুল।
‘একাত্তর ভুলে গেলে চলবে না’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ‘অবহেলা করার চেষ্টা চলছে’ বলেও মনে করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, “আমি কিছুক্ষণ আগে একজনের সাথে কথা বলছিলাম যে, এখন একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, একাত্তরকে একটু ‘পেছনে রাখা’।
আমার মনে হয়, এটা আরেকটা ষড়যন্ত্রের অংশ, দেশের মূল ইতিহাস থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।“যেমন ৪৭ সালের দেশভাগকে অনেকে বলেন যে, ‘এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল’।
এখন আবার একটা লক্ষ্য করছি যে, একাত্তর সালকে পেছনে রাখা। আমরা মনে করি এটা ইতিহাস বিকৃতির একটা…. ।এটার কোনো প্রমাণ নেই, আমার কাছে এটা মনে হয়েছে।
এই বিষয়টা নিয়ে আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।”
গত ১৫ বছর ধরে ইতিহাসকে বিকৃত করার অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারা ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন দেখছেন।“এই সময়ে সেই (মুক্তিযুদ্ধ) ইতিহাস যেন বিকৃত না করি।”
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার অনুরোধ থাকবে, এই দিবসগুলো আপনারা অবহেলা করবেন না, জানার চেষ্টা করবেন।
“অনেক জানেই না কী হয়েছিল, ওই দিন কি তালি মারার দিবস? না তালি মারার দিবস না, ওই দিন কি মিলাদ করার দিবস না খিচুড়ি খাওয়ার দিবস? আমাদের দেশের সবচাইতে বরেণ্য ব্যক্তিদেরকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে ভালো শিক্ষকদেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
“বাসা থেকে নেওয়ার সময়ে বলছিল, ‘এই কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে তো’, এভাবে নিয়ে গেছে। নেওয়ার পর আর ফিরে আসেনি, রায়ের বাজারে তাদের হাত-পা বাঁধা মরদেহ পাওয়া গেছে; মহিলা-পুরুষ সকলের।
এটা আমাদের মনে রাখতে হবে বুদ্ধিজীবীদের কেনো প্রাণটা দিতে হল।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তাদেরকে একইভাবে তুলে নিত অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, “তখনও (মুক্তিযুদ্ধ) এই ‘আয়না ঘরের’ মত ঘর ছিল। এই আয়না ঘরে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছেলেদের?
কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরকে?“একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তাদেরকে ভয় পাইয়ে দেওয়া, তাদেরকে শেষ করা, তাদেরকে ধ্বংস করা।
কেন? একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করা, হাসিনার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে হবে, সেজন্য আয়না ঘরে নিয়ে যাওয়া হত, তাই না।”
‘গণতন্ত্র মানে আওয়ামী লীগের গলা কাটা, বিএনপির মুণ্ডু ছেদ নয়’গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্ব দেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “এটা একটা সংস্কৃতি।আপনি-আমি কীভাবে কথা বলব,
আমি আমার প্রতিবেশীর সাথে কেমন কথা বলব, আমার রাজনীতির প্রতিপক্ষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, সেই বিষয়গুলো আমাদেরকে গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে শিখতে হবে।”
ফখরুল বলেন, “গণতন্ত্র মানে এই নয় যে, ‘আওয়ামী লীগ করলে তাকে গলা কেটে ফেলো আর বিএনপি করলে তার মুণ্ড ছেদ করো’।
তাহলে সেটা কিন্তু গণতন্ত্র নয়।“গণতন্ত্র হচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতা। তোমার কথা বলার অধিকার আছে, আমার বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার আছে। আমি সেটাকে রক্ষা করব, এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র।”
গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে কাজ করতে হবে মন্তব্য করে দলের মহাসচিব বলেন, “আপনাদের সামনে অনেক কাজ।
অনেকে মনে করেছেন যে, হাসিনা ‘পালিয়ে গেছে’, কাজ শেষ হয়ে গেছে। না, কিছুক্ষণ আগে আমাদের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলছিলেন যে, যে আমাদের এই আন্দোলন চলবে নির্বাচন পর্যন্ত।“না, না,
এই নির্বাচনের পরে আরও বহু বহু দিন। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা একটা গণতন্ত্র সংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারব, এটা একটা ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াবে, ওই জায়গাতে আমাকে পৌঁছাতে হবে। তাই আমাদের কাজ অনেক বেশি আছে।”
‘রাজনীতিকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না’
রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ না বানাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সতর্কতাও দেন মির্জা ফখরুল।তিনি বলেন,
“একজন উপদেষ্টা যখন এই কথা বলেন যে, ‘রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে’, এটা অত্যন্ত ঘোরতর অভিযোগ। আমি তীব্রভাবে এর নিন্দা জানাচ্ছি, প্রতিবাদ করছি এবং আমি মনে করি যে, এই ধরনের উক্তি তার প্রত্যাহার করা উচিত।
”ফখরুল এই বক্তব্য রেখেছেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে উদ্দেশ করে। গত বুধবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল পার্টনার্স গভর্ন্যান্স-জিপিজির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে নাহিদ বলেছিলেন, ”রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে সংস্কার তাদের অধীনেই হোক, তাই তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
“পরের দিন যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে মির্জা ফখরুল এই বক্তব্যের সমালোচনা করেন। সেদিনই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি সংবাদ মাধ্যমে যিনি পাঠিয়েছিলেন, সেই মুহম্মদ জসীম উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়।
বিবিসি বাংলাকে জসীম উদ্দিন বলেছিলেন, তথ্য উপদেষ্টা ওই কথা বলেননি। তিনি অসাবধানতা বশত ভুল বক্তব্য দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিলেন।
তবে উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সেই বিজ্ঞপ্তির সংশোধনী দেওয়া হয়নি।ফখরুল বলেন, “আমি মনে করি যে, দয়া করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বা রাজনীতিকে আপনাদের প্রতিপক্ষ বানাবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদেরকে সহযোগিতা করছে।
“আপনি যদি বলেন যে, এটা ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে, আমরা হাজার বার বলেছি, আমাদের চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা বলেছি, এই সরকার হওয়া ব্যর্থ হওয়া মানে জনগণ ব্যর্থ হয়ে যাবে, আমরা ব্যর্থ হয়ে যাব।
তাহলে এই রকম কথা কেন বলবেন আপনি?”বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় আলোচনায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান,
সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদও বক্তব্য রাখেন।