এক অধ্যায়ের সমাপ্তি, এক দায়ের সূচনা
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ এক গভীর শোকের ভারে নত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান মুখ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরলোকগমন কেবল একজন ব্যক্তির জীবনাবসান নয়—এটি একটি দীর্ঘ সংগ্রাম, এক রাজনৈতিক অধ্যায় এবং এক সময়ের সমাপ্তি।
বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এমন এক রাষ্ট্রনায়ক, যাঁর জীবন রাজনীতির আরামদায়ক পথে চলেনি। ব্যক্তিগত জীবনের বেদনাবিধুর ক্ষতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কারাবরণ, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা—সবকিছুকে অতিক্রম করেও তিনি আপসহীন থেকেছেন তাঁর বিশ্বাসে। ক্ষমতা নয়, বরং অধিকার; সুবিধা নয়, বরং দায়িত্ব—এই দর্শনেই তিনি রাজনীতি করেছেন। এ কারণেই তাঁর উপস্থিতি যেমন শক্তিশালী ছিল, তেমনি তাঁর অনুপস্থিতিও গভীরভাবে অনুভূত হবে।
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি কেবল একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেননি; তিনি ভেঙেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক মানসিকতার বহু অদৃশ্য দেয়াল। পুরুষশাসিত রাজনীতির বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—নারীর নেতৃত্ব আপসের নয়, বরং দৃঢ়তার প্রতীক হতে পারে। তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সহনশীলতার আহ্বান এবং জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ—সবই আজ ইতিহাসের অংশ, কিন্তু একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাও।
সমর্থক ও সমালোচকের ভিড়ে তিনি ছিলেন বিতর্কিত, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই—তিনি ছিলেন প্রভাবশালী। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর প্রতি জনগণের আবেগ, শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গাটি ছিল বাস্তব ও গভীর। একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃত শক্তি এখানেই—জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া।
আজ তাঁর জানাযায়, স্মরণসভায় কিংবা নীরব প্রার্থনায় আমরা যখন তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, তখন একই সঙ্গে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এক কঠিন প্রশ্ন—এই শূন্যতায় আমাদের করণীয় কী?
বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় শূন্যতা তৈরি করেছে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনীতিতে নেতৃত্ব, দিকনির্দেশনা ও নৈতিক দৃঢ়তার প্রশ্নে এই শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। কিন্তু ইতিহাস বলে—কোনো ব্যক্তির প্রস্থান রাজনীতির সমাপ্তি নয়; বরং তা নতুন দায়িত্বের সূচনা।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে আমাদের করণীয় কয়েকটি স্পষ্ট জায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়া জরুরি।
প্রথমত, ব্যক্তি-কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে নীতি-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়া। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক—সেই আদর্শকে ধারণ করাই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।
দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার সংগ্রাম অব্যাহত রাখা। তাঁর জীবনের বড় অংশজুড়ে যে গণতন্ত্রের প্রশ্নটি ছিল, তা যেন কেবল স্মৃতিচারণে সীমাবদ্ধ না থাকে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। প্রতিহিংসা নয়, সংলাপ—এই শিক্ষাই আজ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
একই সঙ্গে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিকতা ও মানবাধিকারকর্মীদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, মানুষের অধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সোচ্চার থাকা এখন কেবল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নয়; এটি জাতিগত দায়।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের শিখিয়েছে—প্রতিকূলতার মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়, অসুস্থ শরীরেও দৃঢ় বিশ্বাস বহন করা যায়, এবং সময়ের কঠোরতার মাঝেও ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া যায়।
আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো রয়ে গেছে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাই হবে আমাদের রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব। জাতি যদি তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকার সম্মান জানাতে চায়, তবে তা করতে হবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পথে অবিচল থেকে।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এবং আমাদের এই শোককে দায়িত্বে রূপান্তর করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
মীর্জা ফসিহ উদ্দিন আহমেদ,
চেয়ারম্যান,বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থা(মাসাস)।
প্রধান সম্পাদক : জুয়েল খন্দকার
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : এস এম রাশেদ হাসান
নির্বাহী সম্পাদক : গাজী ওয়ালিদ আশরাফ সামী
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয় : ১০/৩, টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল ঢাকা-১০০০
হট-লাইন নাম্বার : ০১৯৮৮৬৬৩৭৮২, ০১৯৬৭৯৯৯৭৬৬.
Copyright © 2025 দেশপত্র. All rights reserved.