বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম কেবল ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং সময়, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম—যার জীবন কেবল ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার গল্প নয়, বরং দীর্ঘ ত্যাগ, অবিচল দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক গভীর অধ্যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল অনিশ্চয়তা, সংঘাত ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ। সেই কঠিন বাস্তবতায় একজন নারী নেতৃত্বের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসা ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া খুব অল্প সময়েই প্রমাণ করেন—তিনি কেবল উত্তরাধিকার নন, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ও শক্ত অবস্থানের অধিকারী।
তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়ে আছে। সে সময় রাজপথের আন্দোলন, রাজনৈতিক সমঝোতা ও আপসহীন অবস্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল, সেখানে তার নেতৃত্ব ছিল নির্ণায়ক। স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে বাংলাদেশ—যা জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় বেগম খালেদা জিয়ার সময়কাল ছিল বহুমাত্রিক। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার উদ্যোগে তার সরকারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারী নেতৃত্বকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু তার জীবন কেবল অর্জনের তালিকা নয়; এটি ত্যাগেরও এক দীর্ঘ উপাখ্যান। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মামলা, কারাবরণ, এবং দীর্ঘ অসুস্থতা—সবকিছু সত্ত্বেও তিনি আপসহীন থেকেছেন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসে। অনেক সময় তার নীরবতাই ছিল সবচেয়ে শক্ত প্রতিবাদ। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি তার অনুসারীদের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থেকেছেন।
একজন নেত্রী হিসেবে তিনি যেমন সমর্থন পেয়েছেন, তেমনি সমালোচনার মুখেও পড়েছেন। গণতন্ত্রে সমালোচনা স্বাভাবিক—কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন ব্যক্তিগত আক্রমণ ও দীর্ঘমেয়াদি নিপীড়নে রূপ নেয়, তখন সেই চাপ সহ্য করাও এক ধরনের ত্যাগ। এই কঠিন সময়গুলোতে তার পরিবারও কম ভোগেনি। তবুও তিনি ব্যক্তিগত কষ্টকে রাজনৈতিক প্রতিশোধে রূপ দেননি—এটাই তার নেতৃত্বের পরিমিতি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণাকে দৃঢ় করা। মতভিন্নতা, বিরোধী কণ্ঠ ও বিকল্প রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা তিনি বারবার সামনে এনেছেন। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়—এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্য—এই উপলব্ধি তার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল।
আজকের প্রজন্ম যখন রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে দেখে, তখন খালেদা জিয়ার জীবন মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি আসলে ধৈর্য, ত্যাগ ও সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের নাম। তিনি দেখিয়েছেন, নেতৃত্ব মানে শুধু শাসন করা নয়; নেতৃত্ব মানে দীর্ঘদিন ধরে চাপ বহন করা, একা দাঁড়িয়ে থাকা, এবং ইতিহাসের কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া।
তার অবদান বিচার করতে হলে সময়ের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। প্রতিকূলতা, আন্তর্জাতিক চাপ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সবকিছুর মধ্যেও তিনি যে রাজনৈতিক ধারা ধরে রেখেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়। তাকে পছন্দ করা হোক বা না হোক—এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়া কোনো নিখুঁত কিংবদন্তি নন—তিনি রক্তমাংসের মানুষ, ভুল-সঠিকের মধ্য দিয়েই তার পথচলা। কিন্তু ত্যাগ, সংগ্রাম ও অবদানের যে ছাপ তিনি রেখে গেছেন, তা ইতিহাসে অমলিন থাকবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় তার নাম তাই কেবল একটি অধ্যায় নয়—এটি এক পূর্ণাঙ্গ পাঠ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বারবার ফিরে পড়বে।
মো: মাহবুবুল আলম,
নির্বাহী সম্পাদক, জয়যাত্রা,
মহাসচিব, বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থা (মাসাস)।
প্রধান সম্পাদক : জুয়েল খন্দকার
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : এস এম রাশেদ হাসান
নির্বাহী সম্পাদক : গাজী ওয়ালিদ আশরাফ সামী
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয় : ১০/৩, টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল ঢাকা-১০০০
হট-লাইন নাম্বার : ০১৯৮৮৬৬৩৭৮২, ০১৯৬৭৯৯৯৭৬৬.
Copyright © 2026 দেশপত্র. All rights reserved.