লেখক- মাহাবুবুল আলম:- দক্ষিণ পূর্ব ভারত বর্ষে প্রাগৈতিহাসিক কাল হতেই শিক্ষা, সাংস্কৃতি,অর্থনীতি, সভ্যতা ও রাজনৈতিক পাদপীঠ কুমিল্লা শহরের এখন প্রধান ও অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা। কুমিল্লা অনেক ঐতিহাসিক ও পুরাতন শহর হলেও এই শহরটির আভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এই শহরটির ভেতরের যান চলাচলের রাস্তাগুলো এখনও অনেক সেকেলে।যান চলাচলের মত তেমন উন্নত কোনো রাস্তা নাই, বরং শহরের কোনো কোনো অংশে আশপাশের উপশহর গুলো হতেও নাজুক অবস্থায়, আর এই নাজুক অবস্থার মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসাবে যুক্ত হয়েছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। এই শিক্ষা,সাংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পাদপীঠ কুমিল্লা শহরটি স্থানীয় সরকার ও বিগত সময়ের প্রশাসনের অজ্ঞতা আর অবহেলা যেকারনেই হোক এই শহরটির রাস্তাঘাট উন্নত হয় নি, যার কারনে শহরে চলাচলের জন্য আজও কোনো শহর সার্ভিস চালু হয়নি মানুষের চলাচলের জন্য, এই সুযোগে শহরের আশপাশে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটো গ্যারেজ যেগুলো প্রতিদিনই শহরের রাস্তাঘাট গুলোতে চলাচল করে তাছাড়াও প্রতিদিন শহরে ঢুকে পড়ে আশপাশের এলাকা হতে ব্যাটারী চালিত অসংখ্য অটোরিকশা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কুমিল্লা শহরেই রয়েছে কমপক্ষে চার হাজারের মত অটোরিকশা এবং প্রতিদিন আশপাশের আমড়াতলী,পাঁচথুবী, ষোলনল, সদর দক্ষিন,দূর্গাপুর উত্তর, দুর্গাপুর দক্ষিন ইউনিয়ন প্রভৃতি অঞ্চল হতে আরো ৪-৫ হাজার অটোরিকশা প্রবেশ করে এই শহরে। এই অটোরিকশার চালকদের কোনো পরিচয়পত্র থাকে না এবং তাদের কোনো ড্রাইভিং প্রশিক্ষনও থাকে না যার ফলে প্রতিনিয়ত তারা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু পরে তাদের আর খোঁজে বের করা যায় না।
যে পরিমান অটোরিকশা চলে কুমিল্লায়:
আমাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে জানা যায় কুমিল্লা শহরতলী ও আশপাশের এলাকায় ছোট-বড় কমপক্ষে ২০০ এর উপর অনুমোদিত কিংবা অনঅনুমোদিত অটোরিকশা গ্যারেজ রয়েছে। যেগুলোর প্রত্যকটিতে ৫০-২০০ পর্যন্ত নিয়মিত অটেরিক্সা রয়েছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, যেহেতু শহরে কোনো শহর সার্ভিস নাই সেহেতু জনগনের একমাত্র ভরসা যেখানে ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা, সেখানে এই অটোরিকশা নিয়ে আমি কেনো কলম ধরেছি? আসুন এই অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা কিভাবে শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তায় হুমকী সৃষ্টি করছে তা আলোচনা করি, তাইলেি বুঝতে পারবেন।
১। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব:
কুমিল্লা শহরটির রাস্তাঘাটের সক্ষমতার ভিত্তিতে দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার হতে ১৫ শত অটোরিকশা চলাচলের সক্ষমতা রাখে, অথচ সেই স্থানে প্রতিদিন ৬-৮ হাজার অটোরিকশা চলাচল নি:সন্দেহে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে নাজুক করে তোলে। অপর দিকে এই অটোরিকশা চালকদের প্রশিক্ষন না থাকার কারনে ওরা এমনিতেই জ্যাম বাঁধিয়ে রাখে যার ফলে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে পরে থাকতে হয় যাত্রীদের।
২। আইনশৃংখলার উপর প্রভাবঃ
এই অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা আইনশৃংখলার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অটোরিকশা চালকদের কোনো প্রকার পরিচয়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারনে একদিকে ওরা যানজট বাঁধিয়ে রাখে অপর দিকে বিভিন্ন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে সহজেই পালিয়ে যায় পরে যাদের আর খোঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়াও প্রায় প্রত্যাকটি অটোরিকশা গ্যারেজেই শহরের বাহির হতে আসা চালকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, আর এই সুযোগে প্রায় প্রত্যকটি গ্যারেজেই রাতের বেলায় জমজমাট জুয়ার আসর বসে যা রাষ্ট্রীয় আইনে অপরাধ,ফলে এই চালকরাই এক সময় চুরি,ছিনতাই সহ খুনের মত অপকর্মে জড়িয়ে যায়।
৩। নিয়মিত পঙ্গুত্ব ও প্রানহানী:
অটোরিকশা এখন কুমিল্লা শহরে চলমান দূর্ঘটনার নাম, প্রতি দিনই ৫-১০ টি অটোরিকশা দূর্ঘটনা ঘটে যার ফলে মানুষ পঙ্গুত্ব বরন করে এবং প্রানহানীও হয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় কুমিল্লা শহর পঙ্গুদের শহরে পরিনত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
৪। অর্থনৈতিক সমস্যা:
কুমিল্লা শহরের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যার কারন হলো অটোরিকশা অথচ কুমিল্লার সচেতন মহল এই বিষয়টি টেরও পাচ্ছে না। কুমিল্লায় যে পরিমান অটোরিকশা চলাচল করে তার শতকরা ১০% ভাগেরও কম লোক কুমিল্লা শহরের,বাকী ৯০ ভগ লোক শহরের বাহিরের কিংবা অন্য জেলার। কুমিল্লায় চালাচল করা ৮হাজার অটোরিকশার চালকের মধ্যে প্রায় ৭ হাজারই শহরের বাহিরের, আর সেই চালকরা দিনশেষে অর্জিত সমস্ত টাকাই শহরের বাহিরে পাঠিয়ে দেয়। প্রতি জন অটোরিকশা চালক দৈনিক ১ হাজার টাকা করে বাহিরে পাঠালেও দিন শেষে প্রতি সন্ধ্যায় কুমিল্লা শহর হতে প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকা বাহিরে চলে যায় এবং মাসে ১৮ কোটি টাকার সমপরিমান টাকা চলে যাচ্ছ শহরের বাহিরে যা নি:সন্দেহে কুমিল্লা শহরবাসীর উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।
৫।সামাজিক অবক্ষয়:
শহরে যত অটোরিকশা চালক আছে তাদের একটা বিশাল অংশ মাদকাসক্ত যা সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান কারন,তাছাড়াও এই অটোচালকদের পরিচয় পত্র বাধ্যতামূক না থাকার কারনে বহু বিবাহ, নারী কেলেঙ্কারি সহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পরে যার খবর আমরা নিয়মিতই পত্র-পত্রিকায় দেখি,কিন্তু পরে তাদের আর খোঁজে পাওয়া যায় না, এটা একটা বড় সামাজিক অবক্ষয়।
৬।কুমিল্লার বিদ্যুতের দফারফা:
এই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা কুমিল্লার বিদ্যুতের দফারফা করে ছাড়ছে। এমনিতেই কুমিল্লার মানুষ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে নাকাল, তার পরও এত এত অটো রিকশা প্রতিদিন কুমিল্লার বরাদ্দকৃত বিদ্যুতের বেশিরভাগ অংশ ব্যবহার করে যার ফলে কুমিল্লায় বিদ্যুতের দিন দিন লোডশেডিং বাড়ছে আর মানুষ নাকাল হচ্ছে।
করনীয় কি:
এমতাবস্থায় যদি অটোরিকশা হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে শহরের মানুষ বিপদে পড়বে, বরং এই সমস্যা সমাধানে দরকার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি সমন্বিত কর্যকরি পরিকল্পনা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সমস্যা লাঘব হবে বলে মনে করি তা হলো:
১। কুমিল্লা শহরের রাস্তাঘাট জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার ও চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
২। সকল অটোচালকদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থাকরা।
৩।সকল অটোচালকদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা।
৪।শহরের বাহির হতে অটোরিকশা শহরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও কর্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন।
৫। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করন।
৬। স্বল্প সময়ের মধ্যে নিয়মিত শহর সার্ভিস চালুর ব্যবস্থা করা।
৭। জনসচেতনতা তৈরীর জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গুলো প্রচার ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা।
আশা করি উপরিউক্ত বিষয় গুলো মাথায় রেখে প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠন গুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এই সমস্যা সহজেই সমাধান যোগ্য।



