স্টাফ রিপোর্টার :- ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের ছাইয়ের কারণে বাইরে কাপড় শুকাতে দেওয়া যায় না। ছাই রুমের ভেতরও চলে আসে। ঘর নোংরা হয়, খাবার-দাবার ছাইয়ে নষ্ট হয়ে যায়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন পোস্ট করেন ঠাকুরগাঁও শহরের রিপা আক্তার নামের এক গৃহবধূ। সাংবাদিক কামরুল হাসান তাঁর ভ্যারিফাইড পেজে বলেছেন, সুগার মিলের ছাই বন্ধ না হলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ঠাকুরগাঁও রোড বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, প্রতিদিন পৌর এলাকার মধ্যে গড়ে ১৫ থেকে ২০ টন ছাই পরছে। তিনি অবিলম্বে ইএসপি চালুর দাবি জানান।
সরেজমিনেও মেলে এর সত্যতা। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত এ সুগার মিলের ছাইয়ে ঠাকুরগাঁও রোড বাজারসহ আশপাশের সর্বত্র কালো হয়ে আছে। গাছপালা, পুকুর, নদী, খাল-বিল ছাই দিয়ে ভরাট।
ঠাকুরগাঁও সুগার মিল ঠাকুরগাঁও জেলার অন্যতম প্রধান ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৮ সালে সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮-৫৯ মাড়াই মৌসুমে প্রথম চিনি উৎপাদন শুরু করে মিলটি। স্বাধীনতা লাভের পর সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭১সালে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে লুটপাট শুরু হলে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের চিমনির ঢাকনাসহ বেশ কিছু মালামাল লুটপাট হয়। তারপর থেকে চিমনি দিয়ে ছাই বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মিলের আশপাশের এলাকা নোংরা হয়ে যায় এবং ভোগান্তির শিকার হয় জনসাধারণ।
প্রতিবছর সাধারণত ডিসেম্বর মাসে মিলটি চালু হয় এবং ৬০-৭০ দিন চালু থাকে। এ মৌসুমে গত ১৯ ডিসেম্বর নব্বই হাজার মেট্রিক টান চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সুগার মিল চালু হয়।চালু হওয়ার পর পরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার পরদিন সকালে চালু হয়।মিল চালুর পর থেকে প্রতিদিন ব্যাপক হারে ছাই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। বাসাবাড়ির ছাদ, বারান্দা, আনাচে-কানাচে সর্বত্র দেখা মিলে সুগার মিলের ছাই। একদিকে ছাইয়ের দুর্ভোগ অপরদিকে এর সমাধানের পথও জানা নেই কারও। ছাই থেকে রেহাই পাওয়া যায় বর্ষাকালে।
স্থানীয়রা জানান, বিষাক্ত ছাই বাতাসের সঙ্গে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে মাটিসহ পানি দূষণ হচ্ছে। দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে গ্রামের অনেক লোক বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সুগার মিলের প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক সুভাস চন্দ্র সিংহ জানান, চিমনি থেকে ছাই ছড়িয়ে পড়ে এটি সত্য। ছাই ঠেকানোর জন্য ইএসপি ব্যবহার করার কথা। বর্তমানে যেটি আছে, তা সেভাবে কাজ করছে না। দুটি ইএসপির জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।
পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী নিউইয়র্ক প্রবাসী রেজাউল করিম বলেন, সুগার মিল থেকে বা কাঠ পোড়ানো যেখান থেকেই হোক, ধোঁয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি মূলত বায়ুদূষণ। কয়লা, কাঠ পোড়ানোর বায়ুতে পিএম ২.৫ থাকে। এ ছাড়া অ্যামোনিয়া, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বনসহ বিষাক্ত উপাদান থাকে। যা অ্যাজমা, স্ট্রোক, ইমম্যাচিউর বার্থ, বাচ্চা ও বয়স্কদের শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যার জন্য দায়ী। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও বক্ষব্যাধী হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ শুভেন্দু কুমার জানান ক্ষতিকর এই ছাইয়ের কারণে বিভিন্ন ধরনের শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীতে প্রদাহসহ মারাত্মক অসুখ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। দিনাজপুর গাওসুল আজম বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের খ্যাতনামা চক্ষু চিকিৎসক ডাঃটি জামান বলেন, মারাত্মক ক্ষতিকর এই ছাইয়ে চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণও হতে পারে। ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক জানান,মিল চলাকালে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালীর নানা ধরনের অসুখ নিয়ে প্রতিদিন শত শত রোগী আসে। তিনি অবিলম্বে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের চিমনিতে ইএসপি ব্যবহারের দাবি জানান।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম বলেন, সুগার মিলের ছাইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।এদিকে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের একাধিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালের মার্চ মাসে এই মিলে যোগদান করেছেন বর্তমান এমডি শাহজাহান কবির। ফ্যাসিবাদের দোসর এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই স্থানীয় আখচাষীসহ চিনিকল সংশ্লিষ্টদের। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সকল সেক্টরে রদবদলের ঢেউ আসলেও শ্রমিক ইউনিয়ন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উপঢৌকন দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন এমডি। মিলের ছাইসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীগণ তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কারও কল রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, এমডি শাহজাহান কবির গণমাধ্যমকর্মীদের ফোন রিসিভ করতে ভয় পান কারণ তাঁর দূর্নীতির শেষ নেই। ঠাকুরগাঁও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাথে যুক্তদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও এমপিকে ফোনে পাচ্ছেন না।তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোকসান দেওয়া ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের সর্বমোট লোকসান তিনশো কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। লোকসানি এই প্রতিষ্ঠানের কারণে পরিবেশ দূষণের এই ঝুঁকিতে কেন যাবে রাষ্ট্র।
তাঁরা অবিলম্বে চিমনিতে ইএসপি ব্যবহারের দাবি জানিয়ে বলেন, শীঘ্রই তাদের দাবি মানা না হলে এ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের চিমনিতে ইএসপি চালু করতে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং তাদের দূর্নীতিবাজ এমডি শাহজাহান কবিরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এমন প্রত্যাশা স্থানীয় জনসাধারণের।
প্রধান সম্পাদক : জুয়েল খন্দকার
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : এস এম রাশেদ হাসান
নির্বাহী সম্পাদক : গাজী ওয়ালিদ আশরাফ সামী
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয় : ১০/৩, টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল ঢাকা-১০০০
হট-লাইন নাম্বার : ০১৯৮৮৬৬৩৭৮২, ০১৯৬৭৯৯৯৭৬৬.
Copyright © 2025 দেশপত্র. All rights reserved.