দুর্নীতি, লুটপাট ও সীমাহীন অপকর্ম চালিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে এই ভিসি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে নিজেই ফোন করে পুলিশ, ডিবি ও সিটিটিসি টিম ডেকে এনে তাদের হাতে শিক্ষার্থীদের তুলে দিতেন। এরপর রাতভর শিক্ষার্থীদের উপর চলতো নির্মম অত্যাচার, সীমাহীন বর্বরতা। নির্যাতিতদের আর্তচিৎকার ও বাঁচার আকুতিতেও ভিসি’র পাষাণ হৃদয় গলতো না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো গেট বন্ধ করে তাদের আশ্রয় পর্যন্ত দেয়া হতো না।
এখানেই শেষ নয়, শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যেসব বাসা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, ভিসি সেসব ঠিকানা সংগ্রহ করেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সেসব বাসায় রাতভর চলতো পুলিশি তান্ডব। শিক্ষার্থীদের অমানবিক ভাবে মারধোর করার পাশাপাশি তাদের ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকা পয়সা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতো পুলিশ।
সদ্য বিতাড়িত আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আত্মীয় এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে পরিচিত ভিসি আতিকুল ইসলাম বরাবরই আওয়ামীলীগের দোসর হিসেবে খুবই বেপরোয়া ছিলেন। তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করেই তিনি পর পর তিন দফা নিজের মেয়াদ পর্যন্ত বাড়িয়ে নেন ভিসি। বেশুমার দাপটে ভিসি আতিকুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি লুটপাটের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে যাকেই তিনি বাধা মনে করেছেন তাকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হটিয়ে দিয়েছেন। একে একে বিদায় করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সব সদস্যকে, যারাই তার বিরুদ্ধে টু শব্দ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই মনগড়া দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা দিয়েছেন, তুলে দিয়েছেন দুদকের হাতে। এমনকি জঙ্গী তকমা লাগিয়েও দফায় দফায় শিক্ষকদের বরখাস্ত করে তাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ্দ করেছেন। এছাড়াও হুমকি ধমকি, মামলা হয়রানির মাধ্যমে আতিকুল ইসলাম হয়ে উঠেছেন নর্থ সাউথের একচ্ছত্র অধিপতি।
ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ভিসি অধ্যাপক আতিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈতিক চরিত্রস্খলন এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের অভিযোগ তুলে মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ করেছেন। তারা ভিসি ও প্রক্টরকে পদত্যাগের আল্টিমেটামও দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছেন না ভিসি, বরং তিনি উল্টো হুমকি, ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। ভিসি প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তিন জন উপদেষ্টা তার ঘনিষ্ট বন্ধু, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের কঠিন শায়েস্তা করবেন বলেও শাসিয়ে চলছেন। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা চলছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অর্থ জালিয়াতিতে ফেঁসে যাচ্ছেন ভিসি আতিকুল!
বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গাড়ি ও জমি কেনার সময় অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কর্মকর্তা আনোয়ারুল হককে। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করলেও দুদক ভিসি আতিকুল ইসলামের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এতে সংক্ষুদ্ধ অভিযোগকারীরা পুনরায় তদন্ত চেয়ে আবেদন করলে বিস্তৃত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
পুনরায় তদন্ত আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আতিকুল ইসলাম বর্তমানে ভিসি থাকলেও একই সঙ্গে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসারে ভিসি কোনভাবেই ট্রাস্টি বোর্ডে থাকতে পারেন না। ফলে এটা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫ (৭) ধারা আইনানুযায়ি বেআইনি। আইনে আছে ট্রাস্টিরা কোনও সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে বেতন নেন। এর আগে যে সকল দুর্নীতির অভিযোগে ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছিল সে সময় ভিসিও সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সকল ট্রাস্টি মিটিংয়ে সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত থেকে সম্মতি দিয়েছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ১২টি গাড়ি কেনার সময় যে অর্থ জালিয়াতি হয়েছে, সেখানে তিনিও জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের অক্টোবরে নর্থ সাউথের (এনএসইউ) সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থ পাচার মামলার চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। চার্জশিটে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকারের সুপারিশ বা অনুমোদনকে পাশ কাটিয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কিছু সদস্যের অনুমোদন বা সম্মতির মাধ্যমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯ হাজার ৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির ক্রয়মূল্য বাবদ ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা অতিরিক্ত অর্থ অপরাধজনকভাবে প্রদান বা গ্রহণ করেছে।
অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর ও উত্তোলন পক্রিয়ায় আত্মসাৎ করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, এফডিআর করার নামে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট, স্ত্রী স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নামে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি কেনা ও অবৈধভাবে বিলাসবহুল বাড়ির ব্যবহার এবং বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নেওয়ার আড়ালে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নথি তলব করে দুদক।
আইন ভঙ্গ করে তৃতীয় মেয়াদে ভিসি
সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই তৃতীয়বারের মতো উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হলে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য নতুন উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে চলতি দায়িত্ব দিতে হবে। তবে আইন ভঙ্গ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছে এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি)। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি পাসপোর্টধারী আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত চলাকালেই তাকে নতুন করে ১৮ মাসের চলতি দায়িত্ব দেয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এদিকে আইন অমান্য করে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) খতিয়ে দেখছে বলে নিশ্চিত করেছেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন।
এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়কে জঙ্গিমুক্ত করায় বিশেষ ভূমিকা নেয়ার পর থেকেই একটি মহল আমার বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগেরই সত্যতা মিলবে না। ১৪০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে টানা তৃতীয়বার ভিসির নিয়োগ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। এক প্রশ্নের জবাবে ভিসি জানান, সদ্য বিদায়ী আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা থাকার বিষয়টি তার একান্তই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ আমাকে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছিল- এটা বেআইনি হয়ে থাকলে তাদের অপরাধ। আমি তো জোর করে পদটি দখল করিনি।